মোঃ খাইরুজ্জামান সজিব
বিশেষ প্রতিনিধি
পরিবার, সমাজ, পারির্পাশ্বিক অবস্থা ও রাষ্ট্রের সকল প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে দৃঢ়তার সাথে অবহেলিত ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্টির মানুষের উন্নয়নে সেবা দিয়ে অনবদ্য স্বাক্ষর রেখে চলেছেন খুলনার পাখি দত্ত হিজড়া। হিজড়া জনগোষ্টির অধিকার প্রতিষ্ঠায় স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে সমাজের মূল স্রোতধারায় ফেরাতে কাজ করছেন তিনি। ইতিমধ্যেই কাজের সফলতাও পেয়েছেন। চলতি বছর সরকারের মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের জয়িতা অন্বেষণের আওতায় খুলনা বিভাগের শ্রেষ্ট জয়িতা পুরুষ্কার পেয়েছেন তিনি। পিছিয়ে পড়া মানুষকে সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনতে অবদানের স্বাক্ষর রেখে হিজড়া পাখি দত্ত অবহেলিত জনগোষ্টির নক্ষত্র হিসেবেই আর্বিভূত হয়েছেন। গত -২৮ জানুয়ারী খুলনা জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে বাংলাদেশ সরকারের মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রী সিমিন হোসেন রিমি এমপি প্রধান অতিথি হিসেবে হিজড়া পাখি দত্তকে খুলনা বিভাগের শ্রেষ্ট জয়িতা সম্মাননা প্রদান করেন।
জানা গেছে, আবহমান কাল থেকে অবহেলিত ও অনগ্রসর গোষ্টি হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশের হিজড়া সম্প্রদায়। পরিবার, সমাজও রাষ্ট্রে বৈষম্যমূলক আচরনের শিকার এ জনগোষ্টি। অবহেলিত এ জনগোষ্টির একজন হয়ে ও সমাজের সকল প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে দৃঢ়তার সাথে মানুষের সেবার মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে নজির গড়েছেন খুলনার হিজড়া পাখি দত্ত। সমাজের পিছিয়ে পড়া প্রান্তিক জনগোষ্ঠীসহ হিজড়া- ট্রান্সজেন্ডার লৈঙ্গিক বিচিত্রময় জনগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় গড়ে তুলেছেন হিজড়াদের স্বতন্ত্র সংগঠন। যেন হিজড়ারা সমাজের মূল স্রোতধারায় ফিরে এসে সম্মানের সাথে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারে।
জীবন সংগ্রামী পাখি দত্ত একান্ত সাক্ষাৎকারে জানান, ১৯৯২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারী খুলনার সোনাডাঙ্গায় জন্মগ্রহন করেন। পিতা মঙ্গল চন্দ্র দত্ত ও মাতা রিনী রানী দত্তের নিম্নবিত্ত পরিবারে পাখি দত্তের জম্ম ছিল আলোর্বিতকার মত। বাবা মঙ্গল চন্দ্র দত্ত ছিলেন স্বল্প বেতনের নিম্নপদস্থ কর্মচারী শৈশব থেকে শত দরিদ্রতার মাঝে বড় হয়েছেন পাখি। কিন্ত বাবা – মায়ের অপরিসীম আদর- স্নেহে সেই অভাব তিনি খুব একটা বুঝতে পারেননি তিনি যথারীতি শৈশব থেকে কৈশরে পদার্পন করেন। কিন্ত স্বাভাবিক মানুষের তার শারীরিক পরিবর্তন না ঘটায় ক্রমান্বয়ে পরিবার, স্কুল ও সামাজিক জীবনে বার বার নানাবিধ নির্যাতন – হয়রানির শিকার হন যার একমাত্র কারণ ছিলো লিঙ্গ পরিচয়। বয়ঃসন্ধি কালে শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনে তার মধ্যে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। সে একই বয়সের অন্যদের সাথেই স্বাভাবিকভাবে মেলামেশা করতে পারত না। বাড়ীর-আশপাশের লোকজন ও সহপাঠিরা তাকে নিয়ে বিদ্রুপ করতো। এক সময় সমাজের লোকজন তার পরিচয় দেয় হিজড়া হিসেবে। এর প্রভাব পড়ে তার পরিবারেও এক পর্যায়ে -২০০৬ সালে মাত্র সাড়ে ১৩ বছর বয়সে হিজড়া পরিচয়ের জন্য তাকে বাবা- মাসহ পরিবার ছাড়তে হয়। কিন্ত পরিবার ছেড়ে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে তার পক্ষে। পরিবার ছাড়ার ৩ থেকে ৪ মাস পরিচিতও আত্নীয়দের কাছে গেলে ও তারা তাকে স্থান দেয়নি। ইতিমধ্যেই পরিচয় হয় বিন্দু হিজড়া নামে একজনের সাথে তার সহযোগিতায় হিজড়া সম্প্রদায়ের সাথে জড়িয়ে পড়েন পাখি দত্ত। হিজড়া সম্প্রদায়ের আর্থিক ও সামাজিক দৈন্যতার কারনে তোলা তোলা, চাঁদা তোলাসহ বিভিন্ন কাজে যেতে অস্বীকার করায় হিজড়া গুরুর কাছে প্রতিনিয়ত শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। কখনও কখনও না খেয়ে থেকেছেন ট্রেনে ভিক্ষাবৃত্তি পর্যন্ত করেছেন। এ সময় পাখি এই অমানবিক কষ্টকর জীবনের অবসান চেয়েছেন চিরাচরিত হিজড়া পেশা থেকে বেরিয়ে এসে সমাজে নিজের একটি স্বতন্ত্র পরিচয় গড়তে চেয়েছেন পাখি। এ সময় বিন্দু হিজড়ার সহযোগিতায় একটি এনজিওর এইচআইভি প্রকল্পে কাজ শুরু করেন। পরে ২০১৭ সালে একই এনজিওর হিম প্রকল্পে কাজ শুরু করেন। এ কাজের মধ্য দিয়ে তিনি উপলব্ধি করেন সমাজে যারা পিছিয়ে আছেন বিশেষ করে হিজড়া সম্প্রদায়ের জন্য তাকে কিছু করতে হবে।
২০১৮ সালে চরম ঝুঁকি নিয়ে ১১জন সমমনা বন্ধুদের সহযোগিতায় নক্ষত্র মানব কল্যাণ সংস্থা নামে সেচ্ছাসেবী সংগঠন গড়ে তোলেন পাখি। এ সংগঠনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা হয় সমাজের পিছিয়ে পড়া প্রান্তিক জনগোষ্ঠীসহ হিজড়া হিজড়া- ট্রান্সজেন্ডার লৈঙ্গিক বৈচিত্রময় জনগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠা ও তাদেরকে স্বাবলম্বী করা। যাতে করে তারা সমাজের মূল স্রোতধারায় ফিরে এসে সম্মানের সাথে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারেন। এ সংগঠনের মাধ্যমেই তিনি সমাজ উন্নয়নে নানাবিধ কাজ করে চলেছেন। ইতিমধ্যেই এ সংগঠনের সাথে সাড়ে তিনশো হিজড়া এবং চার শতাধিক পিছিয়ে পড়া অন্ত্যজ সম্প্রদায়ের মানুষ যুক্ত হয়েছেন। এ সংগঠন ইতিমধ্যেই যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের রেজিষ্ট্রেশন পেয়েছে এবং সমাজ সেবা অধিদপ্তরের রেজিষ্ট্রেশন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এ সংগঠনের মাধ্যমে ব্লাষ্ট, নাগরিক উদ্যোগও ওয়েভ ফাউন্ডেশনসহ বিভিন্ন সংস্থার সাথে পিছিয়ে পড়া হিজড়া জনগোষ্টির উন্নয়নে কাজ করেছেন।
পাখি দত্ত আরও জানান, প্রথমে নক্ষত্র মানবকল্যান সংস্থা শুধুমাত্র সেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করার উদ্দ্যেশ্য থাকলেও পরবর্তীতে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা করা হয়। এ প্রতিষ্টান পরিচালনায় সকল ব্যয় নিজস্ব অর্থায়ন ও সদস্যদের চাঁদার মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে তিনি ইতিমধ্যেই পিছিয়ে পড়া জনগোষ্টির উন্নয়নে কাজ করে বেশকিছু সফলতাও পেয়েছেন।
পাখি দত্তের আক্ষেপ, তার এ সংস্থা এখনও সরকারী কোন প্রতিষ্ঠানের সহায়তা পায়নি।
অনেক নাম না জানাও যেনতেন সংস্থাকে সরকারী সহায়তা দেওয়া হলেও তাদের কাজকে অবমূল্যায়ন করে কোন সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে না। তবে তিনি আশা করে সরকার পিছিয়ে পড়া ও হিজড়া জনগোষ্টির জন্য অনেক প্রকল্প হাতে নিচ্ছেন সেসব প্রকল্পে তার নক্ষত্র মানবকল্যান সংস্থাকে অর্ন্তভুক্ত করলে তিনি তৃণমূল পর্যায়ে হিজড়া সমাজের উন্নয়নে কাজকে এগিয়ে নিতে পারবেন।
বিভাগীয় শ্রেষ্ট জয়িতা হিজড়া পাখি দত্ত জানান, হিজড়া পরিচয়ে তিনি বিন্দুমাত্র লজ্জিত নন বরং গর্বিত। দৃঢ়তা, কর্মদক্ষতা, সৃজনশীলতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে আজীবন সামাজিক দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি হিজড়া হিজড়া সম্প্রদায় ও সুবিধাবঞ্চিতদের পাশে দাঁড়াতে চান এই র্কীতিমান নক্ষত্র। তিনি এমন একটা প্রতিষ্ঠান গড়তে চান যার মাধ্যমে হিজড়া সম্প্রদায়ের সদস্যদের যথাযথ কর্মসংস্থান হবে। সব হিজড়াকে স্বাবলম্বী করতে কারিগরি ও বাস্তবমুখী প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদেরকে আর্থিক সহায়তা দেয়া। যেন যার যেমন দক্ষতা ও ক্ষমতা সে তেমনই কাজ করে স্বাবলম্বী হতে পারে। একমাত্র আর্থিক উন্নয়ন কর্মসংস্থান ও স্বাবলম্বী করার মধ্য দিয়েই হিজড়াদের চিরাচরিত চাদা তোলাসহ নানাবিধ কাজ থেকে তাদেরকে সমাজের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এজন্য তিনি একটি সুপার শপ করতে চান। একই সাথে হিজড়াদের যোগ্যতা অনুযায়ী সরকারী- বেসরকারী চাকুরীর ব্যবস্থা করতে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে উদ্যোগ গ্রহনের দাবীও জানান তিনি তার এসব কাজ বাস্তবায়নের জন্য তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি কামনা করেছেন।
খুলনা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উপ- পরিচালক হাসনা হেনা জানান, পাখি দত্ত সমাজের দৃষ্টিতে একজন হিজড়া হয়েও তিনি একজন সংগ্রামী নারী।একজন সমাজ সেবক, একজন সফল সামাজিক নেত্রী, সমাজ পরিবর্তনের একজন এজেন্ট, একজন দক্ষ প্রশিক্ষক, একজন প্যারালিগ্যালিষ্ট,একজন মানবাধিকার কর্মী। একজন হিজড়া হয়েও সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখার স্বীকৃতি স্বরুপ সরকারের মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ শীর্ষক কর্মসূচি -২০২২-২৩ এ খুলনা বিভাগে সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছেন যে নারী ক্যটাগরীতে শ্রেষ্ট জয়িতা পুরুষ্কারে ভূষিত হয়েছেন পাখি দত্ত।
আমরা বিশ্বাস করি এই জয়িতাদের অনুপ্রেরণামূলক সাফল্যগাথা আরও অনেক নারীকেই অনুপ্রাণিত করবে। হাজারো নারীর মনে হাঁটি হাঁটি পা পা করে উকি দেওয়া স্বপ্নগুলো পাখা মেলবে আকাশে, তৈরি হবে লাখো জয়িতা হিজড়া পাখি দত্ত। এই সফল নারীদের অপরাজেয় রূপ দেখে সমগ্র সমাজ নারী বান্ধব হবে এবং সমতাভিত্তিক সমাজ র্বিনির্মান ও ত্বরান্বিত হবে বলে প্রত্যাশা করেন তিনি।