মাটি মামুন রংপুর
হামার কপাল খারাপ বাহে। বাড়ির কাছোত হাসপাতাল থাকতেও চিকিৎসাসেবা নাই। কয়েক বছর ধরি হাসপাতালটা বন্ধ। ডাক্তার বইসে না, যন্ত্রপাতি সোগ অকেজো হয়া পড়ি আছে। এ্যলা কিছু হইলে হামাক রংপুর শহর যাওয়া নাগে। কায়ো যদি হাসপাতালটা চালু করে তাইলে হামার উপকার হইল হয়।
এভাবেই আক্ষেপ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন রংপুর নগরীর ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের মাহিগঞ্জ সরেয়ারতল এলাকার কৃষক বুলবুল মিয়া। শুধু এই কৃষকই নয় রংপুরের তিন উপজেলাসহ নগরীর ৬টি ওয়ার্ডের লক্ষাধিক মানুষ ক্ষুব্ধ হাতের নাগালে থাকা বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল হাসপাতালের অচলাবস্থা দেখে।
সরেজমিনে পরিদর্শনে দেখা যায়, রংপুর মহানগরীর মাহিগঞ্জের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়ার হাসপাতালটি জনমানুষ শূন্য। হাসপাতালের সম্মুখে জানালার কাঁচগুলো ভেঙে পড়ছে। নিচ তলায় এক্সরে ঘর, বীর মুক্তিযোদ্ধা বাদশার নামে ওয়ার্ডসহ অন্যান্য ঘরে থাকা আসবাবপত্রে মোটা ধুলোর আস্তর পড়েছে। এক্সরে মেশিনের বিভিন্ন অংশে জং লেগে গেছে।
ওয়ার্ডগুলোর চেয়ার-টেবিল, শয্যা, রোগীর ট্রলির ওপর মাকড়সা বাসা বেঁধেছে। নিচ তলার বীর মুক্তিযোদ্ধা বাদশা ওয়ার্ডের জানালার পাশে জন্মেছে আগাছা।
দোতলায় অপারেশন থিয়েটারে অনেক যন্ত্রপাতি চুরি হয়ে গেছে। যেগুলো রয়েছে সেগুলোও দীর্ঘদিন ধরে হাসপাতাল বন্ধ থাকার কারণে নষ্ট হয়ে গেছে।
অপারেশন থিয়েটারের বিপরীত পার্শ্বে পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ডের বিছানা পড়ে থাকতে থাকতে নষ্ট হয়ে গেছে। ওয়ার্ডের ছাদে ফ্যান ঝুলে থাকলেও পলেস্তারা খসে পড়ছে। এর পাশে টাইলস করা একটি ওয়ার্ড রয়েছে। ব্যবহার না করার কারণে ওই ওয়ার্ডের এসি ও বেডগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। মূল ভবনের পেছনে এ হাসপাতালের একটি টিনসেড ঘর রয়েছে।সেটিরও জরাজীর্ণ অবস্থা।
সেখানে একটি ঘরে হাসপাতালের বিছানা, অপারেশন থিয়েটারের কিছু সরঞ্জাম পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। এরই মধ্যে হাসপাতালের পেছনের দেয়াল ভেঙে পড়েছে। ফলে বর্তমানে যে অবকাঠামো ও যন্ত্রাংশ রয়েছে তা চুরি হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
পুরো হাসপাতালটি দেখভাল করছে রংপুর সিটি কর্পোরেশন থেকে নিযুক্ত একজন নৈশ্য প্রহরী।
স্থানীয়রা বলছেন, অযত্ন আর অবহেলায় সব যন্ত্রাংশ বিকল হয়ে পড়েছে। দীর্ঘদিন ধরে বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। হাসপাতালের কার্যক্রম বন্ধ থাকায় এখন ভূতুরে পরিবেশ বিরাজ করছে। নষ্ট হয়ে গেছে হাসপাতালের আসবাবপত্রসহ মূল্যবান যন্ত্রপাতি।
ফলে চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত রয়েছেন তিন উপজেলাসহ নগরীর ৬টি ওয়ার্ডের লক্ষাধিক মানুষ। হাতের নাগালে হাসপাতাল থেকেও স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হওয়ায় ক্ষুব্ধ তারা। এরই মধ্যে হাসপাতালের জায়গা বেদখল হওয়ার অভিযোগও করছেন স্থানীয়রা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উত্তরাঞ্চলের আদিশহর রংপুরের মাহিগঞ্জে প্রায় শত বছর আগে তাজহাট জমিদার গোপাল লাল রায় বাহাদুর এ অঞ্চলের মানুষের স্বাস্থ্যসেবার জন্য চেরিট্যাবল হাসপাতাল তৈরি করেন। সেই সময় থেকে এ অঞ্চলের মানুষ বিনামূল্যে এ হাসপাতাল থেকে স্বাস্থ্যসেবা পেয়ে আসছিলেন।
দেশ স্বাধীনের পর নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত মাহিগঞ্জ ল্যাবরেটরি সমিতির তত্ত্বাবধানে নামমাত্র মূল্যে মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত হয়ে আসছিল এ হাসপাতালের মাধ্যমে। ১৯৯৫ সালে রংপুর পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান (পরবর্তী সময়ে প্রথম সিটি মেয়র) বীর মুক্তিযোদ্ধা সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টু এ হাসপাতালটি আধুনিকায়নের উদ্যোগ নেন।
সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা টিপু মুনশি এমপি তৎকালীন নিজস্ব অর্থায়নে হাসপাতালটি ৩০ শয্যায় পরিণত করেন। একই সঙ্গে এটি বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল হাসপাতাল হিসেবে নামকরণ করা হয়। স্থানীয় দানশীল ব্যক্তিদের আর্থিক সহযোগিতায় চিকিৎসার যন্ত্রপাতি কিনে এ হাসপাতালের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়। তৎকালীন রংপুর পৌরসভার তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এ হাসপাতালটি ঠিকঠাক চললেও কিছুদিনের মধ্যেই হোচট খায় এর কার্যক্রম। এরপর সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে এ হাসপাতালটি এনজিও, সূর্যের হাসি, ব্যক্তিগত ক্লিনিক, নগর মাতৃসদনসহ বিভিন্ন নামে পরিচালিত হয়।
বর্তমানে পুরো হাসপাতালটি রংপুর সিটি কর্পোরেশন থেকে নিযুক্ত একজন নৈশ্যপ্রহরী দেখাশোনা করছেন। সাইফুল ইসলাম নামের এই নৈশ্যপ্রহরী জানান, প্রায় আড়াই বছর ধরে তিনি এই হাসপাতালের নৈশ্যপ্রহরী হিসেবে নিযুক্ত রয়েছেন। তিনি একাই পুরো হাসপাতাল দেখভাল করেন। এখানে এক্সরে মেশিন, অপারেশন থিয়েটার, অনেকগুলো বেড, চেয়ার, টেবিল, এসি, জেনারেটরসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি রয়েছে সেগুলো ব্যবহার না হওয়ায় নষ্ট হয়ে গেছে।
মাহিগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা সাংবাদিক বাবলু নাগ বলেন, বঙ্গবন্ধু নামটি হচ্ছে বাঙালি জাতির প্রাণের স্পন্দন। বঙ্গবন্ধুর নামে এ হাসপাতালটি বন্ধ রাখা মানে জাতির প্রাণের স্পন্দনকে বন্ধ করে রাখা। আমরা চাই হাসপাতালটি পুনরায় চালু করা হোক।
স্থানীয় শিক্ষক হাসেম আলী বলেন, রংপুরের পুরাতন শহর মাহিগঞ্জের মানুষ যে অবহেলিত হয়ে আসছে এর বড় উদাহরণ এ হাসপাতালটি। এটি গরিব মানুষের চিকিৎসার জন্য বড় অবলম্বন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অদৃশ্য ষড়যন্ত্রণের কারণে আজ তা বন্ধ হয়ে রয়েছে। প্রাথমিকসহ অন্যান্য চিকিৎসাসেবা আরও বড় কলেবরে নিশ্চিত করা হোক, এটা মাহিগঞ্জবাসীর দাবি।
মাহিগঞ্জ উন্নয়ন ফোরামের সংগঠক শাহাদাত হোসেন লিখন বলেন, বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল হাসপাতালটি চালু থাকায় রংপুর জেলার পীরগাছা, কাউনিয়া, মিঠাপুকুরসহ নগরীর ৬টি ওয়ার্ডের মানুষ স্বল্প মূল্যে চিকিৎসা পেয়ে আসছিল। জাতির পিতার নামে এ হাসপাতালটি হলেও তা অবহেলায় পড়ে রয়েছে। এ বিষয়ে রংপুর সিটি মেয়র, জেলা প্রশাসককে দফায় দফায় অবহিত করা হয়েছে। হাসপাতাল চালুর দাবিতে নানা আন্দোলন কর্মসূচিও পালন করা হয়েছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত চালুর কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। আমরা আশা করি অল্প সময়ের মধ্যে এ হাসপাতালটি প্রাণ ফিরে পাবে, এ অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত হবে।
রংপুর-৪ (পীরগাছা-কাউনিয়া) আসনের সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা টিপু মুনশি জানান, ১৯৯৫ সালে দোতলা ভবন করে বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল হাসপাতালটির আধুনিকায় করেছি