শ্যামনগরের জেলেখালীতে মা বনবিবির পূজা সকল ধর্মের মানুষের মিলন মেলা
পরিতোষ কুমার বৈদ্য
শ্যামনগর (সাতক্ষীরা) প্রতিনিধি
সুন্দরবন এলাকায় বনজীবীদের আত্মবিশ্বাসী এক নারী শক্তির নাম বনবিবি। যিনি জেলে, মৌয়াল, বাওয়ালীদের বাঘ রুপী অপশক্তির হাত থেকে রক্ষা করেন। এই বাঘ রুপী অপশক্তির হাত থেকে যেমনটি রক্ষা পেয়েছিল সুন্দরবন এলাকার লোকসংষ্কৃতির শিশু চরিত্র দুঃখে।
সেই বিশ্বাস থেকে ১১৫ বছর পূর্বে শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের পশ্চিম জেলেখালী নামক গ্রামে বাঘের অত্যাচার থেকে রক্ষা পেতে মন্দির প্রতিষ্ঠা করে বনবিবি পূজা শুরু করেন যজ্ঞেশ্বর মন্ডল নামে এক ব্যক্তি। সেই সময়ে জেলেখালী গ্রামে বাঘের খুব অত্যাচার ছিল। প্রতিবছর মাঘ মাসের ১ তারিখ পৌষ সংক্রান্তিতে এই পূজার আয়োজন করা হয়। এইদিন বিভিন্ন এলাকা থেকে নারী-পুরুষ, আবাল বৃদ্ধ, সকল ধর্মের মানুষ এই মেলা দেখতে চলে আসেন। স্থানটি পরিনত হয় লোকসংস্কৃতির এক মিলন মেলায়। এখানে সকল ধরনের খাবার, কাঁচা সবজী, ফল ও মাছও বিক্রয় হয়।
ইতিহাসবিদ সতীশচন্দ্র মিত্রের যশোহর খুলনার ইতিহাস গ্রন্থের তথ্য অনুযায়ী, ১৫০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ সুন্দরবন এলাকায় দক্ষিণরায়, বণিক ধোনাই ও মোনাই এবং গাজীর অস্তিত্বের কথা জানা যায়।
শোনা যায়, সুন্দরবনের এক প্রত্যন্ত গ্ৰামে এক বিধবা মহিলা ও তাঁর ছেলে বাস করত। বাপ হারা ছোট্ট ছেলেটির নাম ছিল দুখে। দুখের দুই জ্ঞাতি কাকা ছিল পাশের গ্ৰামের ধনা ও মনা। একদিন দুখেকে নিয়ে তারা মধু আহরণ করতে যায় সুন্দরবনে।
যাওয়ার সময় দুখের মা ছোট্ট ছেলেকে বলে, বনে তার আরেক মা রয়েছে। বিপদে পড়লে যেন তাকেই স্মরণ করে দুখে। তিনিই সব বিপদ থেকে রক্ষা করবেন।
তখন গভীর বনে বাস করতেন গাজী আউলিয়া। বনের পাহারায় থাকতেন বাঘরূপী অপদেবতা দক্ষিণ রায়। যেমন দাপুটে তার চেহারা, তেমনই ছিল অহঙ্কার। দুজনের মধ্যে বেশ বন্ধুত্ব ছিল।
এদিকে মধু শিকারে এসে কাজে মন নেই দুখের। মায়ের জন্য সারাদিন তাঁর মন কাঁদছে। কতক্ষণে মায়ের কাছে ফিরে যেতে পারবে সে কথাই ভেবে চলেছে।
এমন সময় এক রাতে দক্ষিণ রায় ধনা মনার স্বপ্নে এলেন। মধু ও প্রচুর ধনসম্পত্তির আশীর্বাদ দিলেন তাদের। তবে শর্ত রাখলেন, দুঃখেকে উৎসর্গ করতে হবে তাঁর কাছে। নইলে নৌকা ডুবিয়ে দেবেন।
ধনা মনা এক বাক্যে মেনে নিল দক্ষিণ রায়ের আদেশ। পরেরদিনই এক পরিত্যক্ত দ্বীপে দুঃখেকে ছল করে একা ফেলে আসা হল। সরল দুখে পরে বুঝতে পারল সবটা। তখন হঠাৎই মনে পড়ল তার মায়ের বলা কথা। বনে দুখের আরেক মা রয়েছে। কাঁদতে কাঁদতে সেই মাকেই স্মরণ করল দুখে।
দুখে স্মরণ করতেই তার সামনে এসে দাঁড়ান এক অপরূপ সুন্দরী দেবী। এক হাতে তার খোলা ধারালো তলোয়ার। তিনিই বনবিবি, সুন্দরবনের ত্রাণকর্ত্রী। দুখেকে কোলে তুলে নিতেই সে কাঁদতে কাঁদতে সমস্ত ঘটনা জানাল বনবিবিকে।
সব শুনে রাগে ফেটে পড়লেন বনবিবি। ভাই শাহ জঙ্গলীকে আদেশ দিলেন রণসাজে সজ্জিত হয়ে দক্ষিণ রায়কে পরাস্ত করার। শাহ জঙ্গলি কিছুক্ষণেই দক্ষিণ রায় ও গাজি আউলিয়াকে এনে হাজির করেন বনবিবির পায়ের সামনে। দক্ষিণ রায় উপায় না দেখে বনবিবির বশ্যতা স্বীকার করে নেন।
এই কারণেই বনবিবির মূর্তির সঙ্গেই থাকে একটি ছোট্ট ছেলের মূর্তি। সে আসলে ছোট্ট বাপ হারা দুঃখে। দুঃখের মতোই সুন্দরবনের সমস্ত প্রাণীদের রক্ষার ভার বনবিবির।
বনবিবি ও তাঁর ভাই শাহ জঙ্গলীর সঙ্গেই পূজিত হন দক্ষিণ রায়। কখনও মানুষ রূপে কখনও বা বাঘরূপে। দুখের উপস্থিতি ও শাহ জঙ্গলীর আক্রমণাত্মক রূপ আসলে এই গাঁথার কথাই মনে করিয়ে দিতে চায়।
জেলেখালী গ্রামের দেবীরঞ্জন মন্ডল বলেন, ”১১৫ বছর ধরে আমাদের গ্রামে মা বনবিবির পূজা হয়ে আসছে। এখানে আগে বাঘের খুব অত্যাচার ছিল। বাঘের অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য একই গ্রামের যজ্ঞেশ্বর মন্ডল এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এই দিনে সকল ধর্মের মানুষ এই মেলায় অংশগ্রহণ করেন। এক মিলন মেলায় পরিনত হয়। এই মন্দিরের উন্নতিকল্পে সরকারের সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন। তাহলে আমরা আরও বড় পরিসরে এই মেলার আয়োজন করতে পারব।